চুরি হওয়া স্বপ্ন ও স্মৃতির রহস্যময় গল্প
মূল - আরাভ কাদকা
অনুবাদ - STEM SCHOOL
বইটির মূল্যঃ ৳110 (একশত পনেরো টাকা)
প্রাপ্যতাঃ বইটি ষ্টকে আছে
সে স্মৃতির বাণিজ্য করে—কিন্তু কিছু গোপনীয়তা এমন যা উন্মোচিত হওয়ার জন্য কখনো তৈরি হয়নি।
স্মৃতি বণিক-এ বাস্তবতা বিকৃত হয়, এবং সত্য ঠিক ততটাই ভঙ্গুর, যতটা ভঙ্গুর সে মন যা তা ধারণ করে। পরিচয় করান এলিয়ট ফিচের সঙ্গে, এক নিঃশব্দ, রহস্যময় স্বপ্ন-বাণিজ্যীর, যে মানুষের স্মৃতি কিনে, বিক্রি করে এবং প্রয়োজনে পুনর্লিখন করে। তার বিশেষ ক্লায়েন্টদের জন্য হারানো প্রেম, নিখোঁজ শৈশব, এবং কষ্টের অনুশোচনা—সবকিছু পুনর্লিখন বা মুছে ফেলা সম্ভব।
কিন্তু একদিন, এলিয়ট অজান্তেই এমন একটি স্মৃতি চুরি করে যা এক ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত। এবং ঠিক সেই মুহূর্তে তার নিজস্ব পরিচয়ের ফাইবারগুলো ধীরে ধীরে ছিঁড়তে শুরু করে।
মনস্তাত্ত্বিক উত্তেজনা, অন্ধকার সুররিয়ালিজম, এবং এক অপ্রতিরোধ্য মূলধারার সংমিশ্রণ—স্মৃতি বণিক আপনাকে এমন এক ছায়াময় জগতে নিয়ে যায়, যেখানে স্মৃতি হল মুদ্রা, আর প্রতিটি লেনদেনের দাম চিরন্তন। এলিয়ট যখন সত্যের জালে নিজেকে আটকানোর চেষ্টা করে, প্রতিটি পাতা আপনাকে গভীর এক গোলকধাঁধায় টেনে নেয়—অবসেশন, অপরাধবোধ এবং বিভ্রমের এক অদ্ভুত মিশ্রণে।
যদি আপনি এমন একটি উপন্যাস চান যা শেষ পৃষ্ঠার পরেও আপনার চিন্তায় বিরাজ করে, তাহলে অপেক্ষা করবেন না—আজই প্রবেশ করুন স্মৃতি বণিক-এর মনের জগতে।
ঢাকার শহরটা যেমন প্রাচীন, তেমনি রহস্যে মোড়া। শহরের ব্যস্ততা, গলির ভেতরকার বিশৃঙ্খলা, আর মানুষের হাহাকার—সবকিছুর মাঝেও কিছু জায়গা আছে, যেগুলোর কথা কেউ বলে না। এমনই এক জায়গা আছে পুরনো ঢাকার এক আঁকাবাঁকা গলির শেষে, যেখানে সূর্যের আলো এসে ঢোকে না, আবার রাতও কখনো পুরোপুরি নেমে আসে না। আলো আর অন্ধকারের মাঝামাঝি সেই গলিটা যেন সময়ের এক ভুলে যাওয়া কোণ। আর সেই কোণেই লুকিয়ে আছে “স্মৃতি এক্সচেঞ্জ হাউস”।
বাইরে থেকে দেখলে জায়গাটা নিছক একটা পুরনো দোকানঘর। দরজার উপরে ঝুলে আছে মরিচা ধরা একটি নামফলক—হাতে লেখা, প্রায় মুছে যাওয়া অক্ষরে: "Memory Exchange House"। দরজাটা সবসময় অর্ধেক খোলা থাকে, যেন ভেতরে কেউ আছে, আবার কেউ নেইও। ভেতরে ঢুকলেই বাতাসের গন্ধ পাল্টে যায়—এক ধরনের ঠান্ডা, ধাতব গন্ধ, যা মানুষকে একসাথে কাঁপিয়ে তোলে আর টানে।
এই প্রতিষ্ঠানের মালিকের নাম এলিয়ট ফিচ। মাঝবয়সী মানুষ, মুখে দাড়ি নেই, কিন্তু চোখদুটো গভীর কূপের মতো, যেন কারও ভেতরের অন্ধকার দেখতে পায়। এলিয়ট খুব কম কথা বলে, হাসে না কখনো, অথচ তার চারপাশে এক অদ্ভুত শান্তি ছড়িয়ে থাকে। সে দাবি করে, প্রতিটি স্মৃতির একটি মূল্য আছে—কেউ সেটা টাকার বিনিময়ে দেয়, কেউ সময়ের বিনিময়ে, কেউ আবার তার আত্মার এক টুকরো হারিয়ে ফেলে এই চুক্তিতে।
স্মৃতি এক্সচেঞ্জ হাউসে আসা মানুষগুলো সাধারণ নয়। কেউ আসে কোনো বেদনাদায়ক অতীত মুছে ফেলতে, কেউ আসে এমন কিছু পুনরুদ্ধার করতে যা হারিয়ে গেছে, আবার কেউ আসে কেবল কৌতূহলবশত—দেখতে, আসলেই কি স্মৃতি বিক্রি করা যায়? দোকানের ভেতরে সারি সারি কাঁচের বোতল রাখা আছে—প্রতিটিতে এক একটি স্মৃতি বন্দি। কারো প্রথম প্রেম, কারো মায়ের মুখ, কারো মৃত্যুর আগের মুহূর্ত—সবই এখানে বিক্রির জন্য সাজানো। এলিয়ট বলে, “প্রতিটি স্মৃতি এক একটি আত্মার প্রতিধ্বনি, এবং প্রতিধ্বনিরও একটা দাম আছে।”
এক বিকেলের সময়, যখন গলির ওপাশে আজানের ধ্বনি মিলিয়ে যাচ্ছিল, দোকানের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে এক নারী। তার পরনে কালো শাড়ি, মুখে হালকা পর্দা, চোখদুটি যেন ঝড়ের আগে জমে থাকা মেঘ। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে এলিয়টের টেবিলের সামনে, আর নরম স্বরে বলে, “আমি একটা স্মৃতি কিনতে চাই।”
এলিয়ট মাথা না তোলে জিজ্ঞেস করে, “কোন স্মৃতি?”
নারীটি একটু চুপ করে থেকে উত্তর দেয়, “নিষিদ্ধ স্মৃতি।”
দোকানের বাতাস যেন মুহূর্তেই জমে যায়। বাইরের শব্দ থেমে যায়, সময় থেমে যায়, এমনকি দেয়ালে ঘড়িটাও যেন কাঁপতে কাঁপতে থেমে যায়। “নিষিদ্ধ স্মৃতি”—এই শব্দটা বহু বছর পর কেউ উচ্চারণ করল।
এলিয়ট ধীরে ধীরে চোখ তুলে তাকায় নারীর দিকে। তার চোখে ভয় নেই, বরং একধরনের দৃঢ়তা, যেন সে জানে সে কী চাইছে। এলিয়ট কিছুক্ষণ তাকে নিরবে দেখে, তারপর নিচু স্বরে বলে, “তুমি জানো না তুমি কী চাইছো। কিছু স্মৃতি ভুলে যাওয়াই ভালো। কিছু দরজা একবার খুললে আর বন্ধ হয় না।”
নারীটি ঠান্ডা গলায় উত্তর দেয়, “আমি জানি আমি কী চাই। আমার প্রয়োজন সেই স্মৃতির।”
এলিয়টের ঠোঁটের কোণে এক অদ্ভুত হাসি ফুটে ওঠে। সে ধীরে ধীরে দাঁড়ায়, দোকানের একপাশে গিয়ে কাঁচের তাকের ভেতর থেকে একটা পুরনো, ধুলোমাখা বাক্স বের করে। বাক্সের ঢাকায় লেখা—“N-01: Forbidden Series”। বাক্সটা খুলতেই একটা হালকা নীল আলো বেরিয়ে আসে, ঘরটা ভরে যায় এক অদ্ভুত শীতল আলোয়।
“এই স্মৃতিটা তুমি নেবে?”—এলিয়টের কণ্ঠে এক ধরনের সতর্কতা।
নারীটি শুধু মাথা নাড়ে।
এলিয়ট গভীর নিঃশ্বাস নেয়, যেন সে জানে সামনে কী আসছে, কিন্তু থামাতে পারবে না। সে স্মৃতিটা হাতে তুলে দেয় নারীর দিকে। “এটার মূল্য শুধু টাকায় মাপা যায় না। তুমি যদি এটা নাও, তুমি তোমার এক টুকরো অস্তিত্ব হারাবে।”
নারীটি স্মৃতিটা হাতে নিয়ে বলে, “আমি ইতিমধ্যেই আমার অস্তিত্বের বড় অংশ হারিয়ে ফেলেছি।”
সেই মুহূর্তে, ঘরের বাতি নিভে যায়। জানালার বাইরে ঝড়ের মতো শব্দ হয়, আর গলির বাতাসে ভেসে আসে এক পুরনো সুর—যেন কোনো শিশুর হাসি, আবার কারও কান্নার মিশ্রণ।
এলিয়ট স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। তার চোখে এখন আর সেই শূন্যতা নেই—বরং ভয়। কারণ সে জানে, নিষিদ্ধ স্মৃতি বিক্রি মানেই এক নতুন অন্ধকারের দরজা খোলা।
গলির বাইরে তখন আবার ভোরের আলো উঠছে। কিন্তু সেই আলো এই গলিতে পৌঁছায় না। এখানে সময় থেমে থাকে, আলো হারিয়ে যায়, আর স্মৃতিগুলো বেঁচে থাকে—মানুষের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন হয়ে।
সেদিনের পর “স্মৃতি এক্সচেঞ্জ হাউস”-এর দরজাটা আর আগের মতো খোলা থাকেনি। মাঝে মাঝে কেউ সেই গলির পাশ দিয়ে গেলে শোনে দরজার ভেতর থেকে কারও মৃদু কণ্ঠস্বর—“তুমি কি তোমার স্মৃতি বদলাতে চাও?”
আর তখনই হাওয়ার মধ্যে এক অদ্ভুত গন্ধ ভেসে আসে—অতীতের, ভয়াবহ ভবিষ্যতের, এবং এমন এক বাজারের, যার দরজা একবার খুলে গেলে আর কখনো বন্ধ হয় না।
সেই রাতেই শুরু হয়েছিল এক নতুন অধ্যায়ের গল্প—এক অদৃশ্য বাজারের দরজা খোলার গল্প।