একটি দ্বীপভিত্তিক ভৌতিক উপন্যাস
মূল - আরাভ কাদকা
অনুবাদ - STEM SCHOOL
বইটির মূল্যঃ ৳100 (একশত টাকা)
প্রাপ্যতাঃ বইটি ষ্টকে আছে
কুয়াশা ও কাহিনীতে মোড়া এক দূরবর্তী দ্বীপে দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল পাথরের গঠন—স্থানীয়দের কাছে পরিচিত “স্টোনব্লাড” নামে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এটি ছিল উপাসনার স্থান, আশীর্বাদের প্রতীক, এবং পর্যটকদের আকর্ষণ। কিন্তু কেউ জানত না, এই পাথরের গভীরে লুকিয়ে আছে এমন এক প্রাচীন শক্তি, যা শুধু নিদ্রিত ছিল, বিনষ্ট নয়।
যখন দ্বীপজুড়ে শুরু হয় অদ্ভুত ঘটনা—অজানা কারণে বন্যপ্রাণীর উধাও হয়ে যাওয়া, হঠাৎ ভূকম্পন, আর বাতাসে ফিসফিসিয়ে ওঠা কণ্ঠস্বর—এক তরুণ দ্বীপবাসী তার শৈশব থেকে শেখা সব বিশ্বাসকে প্রশ্ন করতে শুরু করে।
ভক্তি ধীরে ধীরে পরিণত হয় ভয়ে। পাথরের অভ্যন্তরে নিদ্রিত শক্তি জেগে উঠতে শুরু করলে উন্মোচিত হয় দ্বীপের গোপন ইতিহাস—যা শুধু এই দ্বীপ নয়, সমগ্র পৃথিবীর ভবিষ্যৎকেও হুমকির মুখে ফেলে দেয়।
প্রাচীন পাথরের অন্তরে লুকিয়ে থাকা সত্য উন্মোচন করুন—আজই সংগ্রহ করুন স্টোনব্লাড, এবং ডুবে যান বেঁচে থাকা, রহস্য ও প্রাচীন জাগরণের শীতল ভয়ের গল্পে।
দূর সমুদ্রের বুকে, অজানা নীল জলের মাঝে একটি দ্বীপ—যার নাম “লিরান”। মানচিত্রে চিহ্নিত হলেও খুব কম মানুষই সেখানে পা রেখেছে। দ্বীপটি চারদিক থেকে পাথরের প্রাচীরের মতো খাড়া পাহাড়ে ঘেরা, যেন প্রকৃতি নিজেই তার সীমানা টেনে দিয়েছে। সূর্য ওঠার প্রথম আলো যখন সমুদ্রের গায়ে পড়ে, তখন দূর থেকে মনে হয় দ্বীপটি যেন এক টুকরো আলো ঝলমলে স্বপ্ন—বাস্তবতার ছোঁয়া পায় না।
এই দ্বীপেই রয়েছে “স্টোনব্লাড”—একটি বিশাল, রক্তবর্ণ পাথরের গঠন, যা দূর থেকেই জ্বলজ্বল করে ওঠে। স্থানীয়দের কাছে এটি কেবল একটি প্রাকৃতিক গঠন নয়, বরং দ্বীপের আত্মা। তারা বলে, “স্টোনব্লাড” হলো দ্বীপের রক্ষক, যার উপস্থিতিতে প্রকৃতি আশীর্বাদপ্রাপ্ত। প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময় তারা সেখানে উৎসব করে, দোয়া পড়ে, পশু কোরবানি দেয় এবং সমুদ্রের দিকে মাথা নত করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে।
কিন্তু সব গল্পেরই যেমন অদৃশ্য ছায়া থাকে, এই দ্বীপেরও আছে কিছু গোপন অন্ধকার। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে অদ্ভুত কিছু ঘটতে শুরু করেছে। হালকা ভূমিকম্প যেন প্রতি সপ্তাহেই অনুভূত হচ্ছে। রাতে বাতাসে এমন এক অজানা শব্দ ভেসে আসে, যা কারও মুখে শোনা যায় না, কিন্তু কানে বাজে—একটা হালকা ফিসফিসানি, যেন কেউ বা কিছু জেগে আছে এই দ্বীপের নিচে।
গ্রামের মানুষরা ভয় পেয়েছে। তাদের বিশ্বাস, হয়তো “স্টোনব্লাড”-এর আত্মা রেগে গেছে। তারা বলাবলি শুরু করেছে, কারও না কারও পাপের কারণে দ্বীপের আশীর্বাদ নষ্ট হচ্ছে। বৃদ্ধরা সতর্ক করছে, তরুণদের বলছে যেন কেউ পাহাড়ের পাদদেশে না যায়, বিশেষ করে সূর্যাস্তের পর। কিন্তু তরুণদের মধ্যে একজন—আরিয়ান—এই ভয়কে ভাঙার চেষ্টা করছে।
আরিয়ান বয়সে কেবল বিশের কোঠায়, তবে তার কৌতূহল সীমাহীন। ছোটবেলা থেকেই সে স্টোনব্লাড নিয়ে নানা গল্প শুনেছে—কেউ বলে, পাথরের ভেতর আগুন জ্বলছে; কেউ বলে, এটি আসমানের কোনো টুকরো, যা নেমে এসেছে বহু বছর আগে। কিন্তু আরিয়ানের মনে হয়, সবকিছুরই বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। সে দ্বীপের প্রাচীন কাহিনীগুলো শুনে শুধু মুগ্ধ নয়, প্রশ্নবিদ্ধও হয়। কেন ভূমিকম্প শুধু এই দ্বীপেই হচ্ছে? কেন পশুরা হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে? আর কেন বাতাসে সেই অদ্ভুত শব্দগুলো শোনা যায়, যখন রাত নিস্তব্ধ হয়?
এক সন্ধ্যায়, সমুদ্রের ধারে বসে সে তার বন্ধু রাইয়ানের সঙ্গে কথা বলছিল। সূর্য তখন ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে, আকাশে রক্তবর্ণ আভা ছড়াচ্ছে, ঠিক যেন “স্টোনব্লাড”-এর রঙ।
—“রাইয়ান,” আরিয়ান বলল, “তুই কি কখনো ভেবেছিস, যদি এই পাথরটা আসলে কোনো প্রাচীন জিনিস হয়? হয়তো মানুষের তৈরি, অথবা… অন্য কিছু?”
রাইয়ান হাসল, “তুই আবার শুরু করলি! আমাদের দাদারা বলে গেছেন, ওটা আল্লাহর সৃষ্টি। ওর ভেতরে কেউ হাত দিতে পারবে না। যে চেষ্টা করবে, সে শাস্তি পাবে।”
আরিয়ান চুপ করে রইল। সমুদ্রের ঢেউগুলো যেন তার মনে প্রশ্নের ঢেউ তুলল। সে জানত, ভয়কে উপেক্ষা করা বিপজ্জনক, কিন্তু না জানার ভয় আরও বড়।
রাতে বাড়ি ফিরে সে পুরোনো দাদার বই খুলে বসল। বইটির পাতাগুলো হলুদ হয়ে গেছে, গন্ধে সময়ের ছাপ। সেখানে একটি অধ্যায়ে লেখা—“প্রাচীন কালে লিরান দ্বীপে এক আগুনের দেবতা নেমে এসেছিল। তার হৃদয় পাথরে পরিণত হয়, আর সেই হৃদয় থেকেই সৃষ্টি হয় স্টোনব্লাড।”
আরিয়ান জানে, ইসলাম আগুনের দেবতা বা দেবতার কোনো ধারণা মানে না, কিন্তু সে ভাবতে থাকে—হয়তো এই ‘হৃদয়’ কথাটির মধ্যে অন্য কোনো ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে। হতে পারে এটি কোনো প্রাচীন খনিজ, অথবা কোনো জ্বালামুখীর অবশিষ্টাংশ।
কৌতূহল বাড়তে থাকে। সে ঠিক করে, আগামীকাল ভোরে, যখন সূর্যের আলো এখনো পুরোপুরি দ্বীপে নামে না, সে যাবে স্টোনব্লাডের পাদদেশে। সে চায় নিজের চোখে দেখতে, সত্যি কি পাথরটি অদ্ভুত আলো ছড়ায়, নাকি মানুষের বিশ্বাসই তার আলোর উৎস।
ভোরের প্রথম প্রহর। কুয়াশায় ঢাকা পথ ধরে আরিয়ান এগিয়ে চলল। দূরে “স্টোনব্লাড” ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হলো—লালচে, বিশাল, আর অচেনা এক শক্তির আভায় মোড়া। বাতাসে হালকা গন্ধ—ধোঁয়া আর লবণাক্ত জলের মিশ্রণ। তার বুক ধকধক করছে। যখন সে পাথরের কাছে পৌঁছায়, তখন তার পায়ের নিচের মাটি কেঁপে ওঠে। ছোট্ট এক কম্পন, কিন্তু যথেষ্ট যেন সতর্কবার্তা দিতে।
আরিয়ান থেমে যায়। তার মনে প্রশ্ন জাগে—এটা কি কেবল ভূমিকম্পের অংশ, নাকি “স্টোনব্লাড” সত্যিই জেগে উঠছে? সে হাত বাড়িয়ে ছোঁয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু তার আঙুল ছোঁয়ার আগেই এক ঝলক তীব্র লাল আলো ঝলসে উঠল, আর সঙ্গে সঙ্গে চারদিকের বাতাস ভারী হয়ে গেল।
তার হৃদয় কাঁপছে, চোখে বিস্ময়, মুখে একটাই শব্দ—
“এটা… এটা কী?”
ঠিক তখনই দূর থেকে ভেসে আসে সমুদ্রের গর্জন, যেন গভীরের কেউ জেগে উঠছে, বহু বছর নিদ্রার পর।
দ্বীপ তখনও নিস্তব্ধ, কিন্তু সেই নিস্তব্ধতার ভেতরেই শুরু হলো এক অদ্ভুত পরিবর্তন—যার সাক্ষী হলো কেবল আরিয়ান, আর সমুদ্রের অনন্ত ঢেউ।