জঙ্গলে টিকে থাকা, প্রতিশোধ ও আতঙ্কের এক দৈত্যাকৃতি কুমির থ্রিলার
মূল - আরাভ কাদকা
অনুবাদ - STEM SCHOOL
বইটির মূল্যঃ ৳130 (একশত ত্রিশ টাকা)
প্রাপ্যতাঃ বইটি ষ্টকে আছে
এক ভয়ংকর শিকারি জেগে উঠেছে—এবং নদী রক্তে লাল হবে।
এক প্রত্যন্ত গ্রামের উপর নেমে আসে এক প্রাচীন কিংবদন্তির অভিশাপ—লোভায়াথান নামে এক বিশাল কুমিরের আতঙ্ক। বহু বছর ধরে এটি কেবল গল্প বলে মনে করা হতো, কিন্তু এবার সে ফিরে এসেছে—আরও হিংস্র, আরও ক্ষুধার্ত।
গ্রামের মানুষ ডাকে তাদের শেষ আশার নাম—এক বৃদ্ধ শিকারিকে, যে একসময় এই দানবের মুখোমুখি হয়েছিল এবং প্রতিজ্ঞা করেছিল, আর কখনো শিকার করবে না।
শুরু হয় এক মৃত্যুঝুঁকিপূর্ণ অভিযান—অন্ধকার নদীর স্রোত, ভয়ঙ্কর জঙ্গল আর এক মানুষের অতীত ব্যর্থতার ছায়ার মধ্য দিয়ে। যখন শিকারি ও শিকার একে অপরের প্রতিচ্ছবিতে মিশে যায়, তখন উদঘাটিত হয় বহু বছরের গোপন সত্য। টিকে থাকা তখন শুধু দানবকে হত্যা নয়—বরং আত্মমুক্তির এক যাত্রা।
এখনই কিনুন, ডুব দিন এমন এক জগতে—যেখানে দানবেরা সত্যিই আছে… আর কিছু কখনো মরে না।
ভোরের আলোটা তখনও পুরোপুরি ফোটেনি। আকাশ যেন এক বিশাল ধূসর চাদর মেলে রেখেছে গ্রামটার উপর—একটুকরো রোদও ভেদ করে আসতে পারছে না মেঘের স্তর। নদীর পাড়ে হালকা কুয়াশা ভাসছে, ঠিক যেন পৃথিবীর নিঃশ্বাস। বাতাসে একটা কাঁপুনি আছে, এমন কাঁপুনি যা হয়তো ঠান্ডার জন্য নয়—ভেতরের কোনো অজানা শীতলতার জন্য।
গ্রামটার নাম রায়নগর। মানচিত্রে খুঁজলে পাওয়া যায় না, কারণ মানচিত্রের জন্য এই জায়গাটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু এখানকার মানুষের কাছে এই নদী—‘কালীগঙ্গা’—জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে এক সেতুবন্ধন। নদীর জলে তারা মাছ ধরে বাঁচে, আবার সেই নদীর দিকেই তারা শেষ যাত্রায় পা বাড়ায়।
সেই ভোরেই কিছু একটা ঘটে গেল যা বদলে দিল গ্রামের ইতিহাস।
বুড়ো জেলে গফুর মিয়া সেদিন সকালে একাই নেমেছিল নদীতে। তার নৌকাটা ছোট, পুরোনো, কিন্তু তার হাতের ছোঁয়ায় সেটাই যেন নদীর বুক চিরে চলে যেত অনায়াসে। গফুর মিয়া ছিল গ্রামের সবচেয়ে অভিজ্ঞ জেলে। বছরের পর বছর সে এই নদীর প্রতিটি ঢেউ, প্রতিটি ঘূর্ণি চিনে নিয়েছিল। কিন্তু সেই সকালেই, কোনো এক অজানা শক্তির সামনে তার অভিজ্ঞতা ব্যর্থ হয়ে গেল।
ঘন্টাখানেক পর নদীর ঘাটে ভেসে এল তার নৌকা। প্রথমে কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারল না। নৌকাটা আস্ত আছে, কিন্তু ভিতরে কেউ নেই। শুধু জালের টুকরো, ছেঁড়া বাঁশের মাথা আর রক্তে রঞ্জিত পানি। লালচে তরলটা নদীর জলে ছড়িয়ে পড়েছে—যেভাবে কালি ছড়িয়ে যায় পানির উপর, ধীরে ধীরে, নিঃশব্দে।
গ্রামের লোকজন জড়ো হতে লাগল ঘাটে। কেউ মুখে হাত চাপা দিয়ে তাকিয়ে রইল, কেউ বিড়বিড় করে নাম পড়ল আল্লাহর। কেউ বলল, “এটা নিশ্চয়ই কোনো কুমিরের কাজ।” আবার কেউ চাপা গলায় বলল, “না রে ভাই, কুমিরে এতটা করে না। এটা কিছু একটা… অন্যরকম।”
বাতাসে একটা অদ্ভুত ভার ছড়িয়ে পড়ল। নদীর দিকে কেউ আর এগোতে চাইল না। এমনকি যারা প্রতিদিন সকালে মাছ ধরতে নামত, তারাও সেদিন ঘরে বসে রইল।
বিকেল নাগাদ খবরটা ছড়িয়ে পড়ল পুরো রায়নগরে—গফুর মিয়া নিখোঁজ। তার দেহ মেলেনি কোথাও। শুধু নদী লাল হয়ে উঠেছে।
রাত নেমে এলে গ্রামটা হয়ে উঠল আরও অচেনা। হঠাৎই বিদ্যুৎ চলে গেল, আর দূরে কোথাও শোনা গেল নদীর গর্জনের মতো একটা শব্দ—গভীর, ভারী, যেন পৃথিবীর তলা থেকে উঠে আসছে। কেউ কেউ বলল, “লোভায়াথান ফিরেছে।”
এই নামটা গ্রামের পুরোনো মানুষরা জানে। এক কিংবদন্তি, শত বছর পুরোনো। বলে, একসময় এই নদীতে লোভায়াথান নামে এক দানব বাস করত—আধা মাছ, আধা অন্ধকারের সৃষ্টি। তার রক্ত লাল, চোখে আগুন, আর তার গর্জনে নদী সেদিনও রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল। তখন থেকে গ্রামের মানুষ নদীতে নামার আগে দোয়া পড়ে, মাথায় পানি ঢালে, যেন সেই অশুভ চোখ থেকে বাঁচা যায়।
কিন্তু যুগ কেটে গেছে, গল্পটা ধীরে ধীরে হারিয়ে গিয়েছিল সময়ের কুয়াশায়। নতুন প্রজন্মের কেউ সেটাকে সত্যি বিশ্বাস করত না। তারা বলত, “ওসব পুরোনো লোকের বানানো গল্প।”
কিন্তু আজকের এই ঘটনার পর কেউ আর নিশ্চিত হতে পারল না।
রাত গভীর হলে নদীর ধার দিয়ে হাঁটছিল এক কিশোর, নাম জুবায়ের। সে গফুর মিয়ার নাতি। সারা দিন ধরে কান্নাকাটি করার পর সে চুপিচুপি ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে, দাদার কোনো চিহ্ন খুঁজতে। নদীর ধারে এসে সে থেমে গেল। চাঁদ দেখা যায় না, শুধু কুয়াশা আর কালো জলের গন্ধ।
ঠিক তখনই সে শুনল কিছু একটা—নরম অথচ গভীর এক শ্বাস, যেন বিশাল কোনো প্রাণী নিচু স্বরে নিশ্বাস নিচ্ছে। নদীর জলে ঢেউ উঠল, আর জুবায়েরের চোখে পড়ল কিছু একটা। পানির নিচে, গভীরে, যেন একটা ছায়া নড়ছে—দৈত্যাকার, অচেনা।
তার বুকের ভেতর কাঁপুনি ধরল। পা পিছিয়ে যেতে চাইল, কিন্তু নদীর দিক থেকে এল এক কণ্ঠস্বর—গভীর, অমানবিক, অথচ স্পষ্ট।
“রক্ত এখনো ঠান্ডা হয়নি...”
জুবায়ের চিৎকার করে উঠল, আর তার চিৎকারে ভোরের নিস্তব্ধতা ছিঁড়ে গেল। দূরে গ্রামের কুকুরগুলো একসাথে ডেকে উঠল, আর নদীর ওপরে ভেসে উঠল এক চিলতে লালচে আলো, যেন সূর্যোদয়ের আগেই নদী নিজেই রক্ত হয়ে উঠেছে।
পরদিন সকালে মানুষ আবার ঘাটে এল। দেখা গেল নদীর পানি সম্পূর্ণ লালচে রঙের, আর ভেসে আছে একটা ছোট কাঠের তক্তা—গফুর মিয়ার নৌকার অংশ। তাতে আঁচড়ের মতো দাগ, কিন্তু দাগের রেখাগুলো এক অদ্ভুত ভাষায় লেখা।
কেউ পড়তে পারল না। কিন্তু সবাই জানল—এটা কোনো মানুষের কাজ নয়।
রায়নগর গ্রামের শান্ত জীবন শেষ হলো সেদিন। আর কালীগঙ্গা নদী পেল নতুন এক নাম—“রক্তের নদী।”
এই নদী এখন কেবল জলের ধারা নয়, একটা প্রতীক্ষা। কীসের জন্য, কেউ জানে না। কিন্তু সবাই অনুভব করছে—অদ্ভুত এক উপস্থিতি তাদের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, নিঃশব্দে, অদৃশ্যভাবে।
আর সেই উপস্থিতির শুরু এখানেই—যেদিন নদী রক্ত হয়ে উঠেছিল।