একটি রক্তিম বাগান
মূল - আরাভ কাদকা
অনুবাদ - STEM SCHOOL
বইটির মূল্যঃ ৳110 (একশত দশ টাকা)
প্রাপ্যতাঃ বইটি ষ্টকে আছে
সময় যেন থেমে গেছে এমন এক দূরবর্তী গ্রামে কেউ বুড়ো হয় না—আর কেউ সাহস করে জিজ্ঞেসও করে না, কেন এমনটা হয়।
ড. অর্জন শান্তি খুঁজতে এই ছবির মতো সুন্দর, অমর গ্রামে আসেন। কিন্তু এখানে এসে তিনি আবিষ্কার করেন এক ভয়ংকর গোপন সত্য—যা লুকিয়ে আছে রক্তিম রঙের এক রহস্যময় বাগানের গভীরে। গ্রামের লোকেরা ফিসফিসিয়ে বলে, এই বাগানের ফল খেলে পাওয়া যায় চিরযৌবন। কিন্তু অমরত্বের জন্য দিতে হয় ভয়াবহ মূল্য—যে মূল্য কেউ কখনো দিতে চায় না।
বিজ্ঞানীর কৌতূহল যখন অন্ধকারে রূপ নেয়, তখন অর্জনের সামনে উন্মোচিত হয় এমন এক দুঃস্বপ্ন, যা মানুষ জানার জন্য তৈরি হয়নি।
রক্তিম বাগান এমন এক মনস্তাত্ত্বিক থ্রিলার যা ভৌতিক কল্পনা, লোকগাঁথা ও বিজ্ঞানের মিশ্রণে সৃষ্টি করেছে এক অসাধারণ অন্ধকার সৌন্দর্য। পাঠককে ভাবাবে, সুন্দর জিনিসগুলোর পেছনে কখনো কখনো কত ভয়ংকর সত্য লুকিয়ে থাকে।
আরাভ খাড়কার অনন্য গল্পবলির জগতে ডুবে যান—যেখানে সৌন্দর্য আর আতঙ্ক হাত ধরাধরি করে হাঁটে, আর অমরত্ব হয় মানুষের সবচেয়ে ভয়ংকর শাস্তি।
রহস্য উন্মোচন করুন। নিষিদ্ধ ফলের স্বাদ নিন। এখনই কিনুন এবং আবিষ্কার করুন রক্তিম বাগানের গোপনতম অন্ধকার।
দূর প্রান্তের সেই গ্রামের নাম কেউ ঠিক জানে না। মানচিত্রে তার অস্তিত্ব মেলে না, গুগল সার্চেও কিছু পাওয়া যায় না। কিন্তু ডাঃ অর্জনের কাছে জায়গাটির নামই ছিল তার আকর্ষণ—“নিস্তব্ধ গ্রাম।” বহু বছর ধরে শহরের হাসপাতালের শব্দ, মেশিনের গুনগুন আর জীবনের তাড়া-তাড়ির মধ্যে কাটিয়ে তিনি যেন নিজের ভিতরকার মানুষটাকে হারিয়ে ফেলেছিলেন। তাই একদিন হঠাৎ, এক অচেনা ভোরে, তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন—সবকিছু ফেলে যাবেন। মানুষের ভিড় থেকে দূরে, এমন কোথাও যাবেন যেখানে সময় আর জীবন ধীর গতিতে চলে, যেখানে প্রতিটি নিশ্বাসে শান্তি আছে।
যাত্রাপথটি ছিল দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর। শহর থেকে দূরে, পাথুরে রাস্তা শেষে কাঁচা পথ, আর তার পরেই শুরু সেই অজানা গ্রাম। যতই তিনি ভেতরে ঢুকছিলেন, চারপাশের দৃশ্য যেন বদলে যাচ্ছিল। বাতাসে অদ্ভুত এক শীতলতা, পাখির ডাক থেমে গেছে, গাছের পাতাগুলো নড়ছে না, যেন প্রকৃতিও এই গ্রামের নীরবতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শ্বাস নিচ্ছে।
অর্জনের গাড়িটি যখন গ্রামের প্রথম চৌরাস্তার পাশে থামল, তিনি দেখলেন একটি পুরনো কাঠের ফলক, তাতে হালকা ঝাপসা অক্ষরে লেখা—“স্বাগতম”। কিন্তু নিচে গ্রামের নাম নেই। যেন কেউ ইচ্ছে করেই তা মুছে দিয়েছে। এই অসম্পূর্ণ স্বাগতমই যেন তার মনে এক ধরণের অদ্ভুত টান জাগিয়ে তুলল—যেন কেউ তাকে ভিতরে ডাকছে, আবার সাবধানও করছে।
গ্রামে ঢুকতেই প্রথম যে বিষয়টি তার চোখে পড়ল, তা হলো মানুষের মুখ। সবাই অদ্ভুতভাবে শান্ত, স্থির। কেউ হাসছে না, কেউ কাঁদছে না, কারো মুখে ক্লান্তির ছায়া নেই। বয়স বোঝা যায় না—যুবক, বৃদ্ধ, নারী, পুরুষ—সবাই একই রকম সতেজ, একই রকম ত্বকের দীপ্তি, যেন সময় এখানে কারো শরীরে হাত দিতে পারেনি।
অর্জন ভাবলেন, হয়তো এটি কেবল তার চোখের ভুল। শহরের ঘুমহীন জীবনে চোখ বিভ্রমে ভোগে, হয়তো সেটাই ঘটছে। কিন্তু গ্রামের ভেতর যতই তিনি হাঁটলেন, এই অদ্ভুত সমতা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল। প্রতিটি মুখ যেন একে অপরের প্রতিচ্ছবি, কণ্ঠগুলো শান্ত অথচ অস্বাভাবিকভাবে ধীর।
“আপনি শহর থেকে এসেছেন?”—একজন তরুণ পুরুষ তার দিকে এগিয়ে এলো। কণ্ঠটি ছিল নরম, কিন্তু তাতে কোনো আবেগ নেই। অর্জন হেসে মাথা নেড়ে বললেন, “হ্যাঁ, একটু বিশ্রাম নিতে চেয়েছিলাম। শহরের জীবনটা... একটু বেশি দ্রুত।”
তরুণটি শান্ত দৃষ্টিতে বলল, “এখানে সময় ধীরে চলে, ডাক্তার সাহেব। হয়তো আপনি তা পছন্দ করবেন।”
তার চোখে এক মুহূর্তের জন্য অদ্ভুত এক ঝলক দেখা গেল—না আনন্দ, না দুঃখ—কিছু একটা মাঝামাঝি, যা মানুষের চোখে সচরাচর দেখা যায় না।
অর্জন একটি পুরনো কাঠের বাড়িতে আশ্রয় নিলেন। বাড়িটি গ্রামের প্রান্তে, চারপাশে ঘন বন আর একটিমাত্র সরু পথ। দরজার পাশে একটি পুরনো প্রদীপ জ্বলছিল, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তাতে কোনো ধোঁয়া নেই। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে তিনি অনুভব করলেন—বাতাসে এক ধরনের গন্ধ আছে, যা তিনি আগে কখনও পাননি। মাটির সঙ্গে মিশে থাকা কোনো অচেনা সুবাস, যা একইসঙ্গে স্নিগ্ধ ও অস্বস্তিকর।
রাত নামল খুব ধীরে। আকাশে তারা নেই, তবু চারপাশে এক মৃদু আলো ছড়িয়ে পড়েছে—যেন চাঁদ নেই, অথচ চাঁদের আলো আছে। জানালার বাইরে তাকিয়ে অর্জন দেখলেন, গ্রামের লোকেরা সবাই একই সময়ে ঘর থেকে বের হচ্ছে, নীরবে নদীর দিকে যাচ্ছে। তাদের পদক্ষেপে কোনো শব্দ নেই। তিনি জানালার ফাঁক দিয়ে দেখলেন, নদীর ধারে তারা দাঁড়িয়ে কোনো এক অজানা দিকের দিকে তাকিয়ে আছে—অবচেতনভাবে, একই ভঙ্গিতে, একই দৃষ্টিতে।
সেই মুহূর্তে অর্জনের মনে হলো—এই গ্রামে কিছু একটা আছে, যা সাধারণ নয়। মানুষগুলো যেন জীবিত অথচ সময়ের বৃত্তে আটকে আছে। তিনি নিজের হাতে নোটবুক তুলে নিলেন, প্রথম পৃষ্ঠায় লিখলেন—
“এই গ্রামের নীরবতা শব্দের থেকেও গভীর।”
কিন্তু যখন তিনি জানালার দিকে ফিরলেন, দেখলেন এক তরুণী দাঁড়িয়ে আছে। সাদা পোশাক, নিরব মুখ, চোখে এক গভীর শূন্যতা। সে কোনো কথা বলল না, কেবল ধীরে মাথা ঝুঁকিয়ে জানালার পাশে রাখা প্রদীপের দিকে ইশারা করল। প্রদীপের আলো হঠাৎ নিভে গেল।
ঘরটি অন্ধকারে ডুবে গেল, আর অর্জনের মনে হলো—তার নিস্তব্ধতার খোঁজ হয়তো সত্যিই শুরু হয়েছে, কিন্তু এটি শান্তির নয়, রহস্যের নিস্তব্ধতা।
রাতের নীরবতায় এক অদ্ভুত সুর বেজে উঠল, যেন দূরের নদী থেকে কেউ ডাকছে—একটা আহ্বান, যা ভয় আর কৌতূহলের মাঝামাঝি কোথাও।
পরদিন সকালে, যখন সূর্য উঠল, গ্রামটি একইরকম ছিল। কেউ ঘর থেকে বের হয়নি, কেউ কথা বলেনি। কিন্তু অর্জনের টেবিলের উপর রাখা তার নোটবুকে নতুন একটি বাক্য দেখা গেল, যা তিনি লেখেননি—
“স্বাগতম, ডাঃ অর্জন। সময় এখানে থেমে নেই, আপনিই এখন তার অংশ।”
তারপর নিস্তব্ধতার মাঝেও যেন এক অজানা শব্দ শোনা গেল—একটি সূক্ষ্ম নিঃশ্বাসের মতো, যা বলে উঠল, “এখানে কেউ বুড়িয়ে যায় না...”
আর ঠিক তখনই, অর্জনের মনে হলো, হয়তো তিনি এমন এক স্থানে পা রেখেছেন যেখানে মানুষ নয়, সময়ই শাসন করে।
এবং এখানেই শুরু হলো তার অজানা যাত্রা—এক নিস্তব্ধ গ্রামের, যেখানে প্রতিটি মুহূর্তে লুকিয়ে আছে এক অদ্ভুত সত্য, যা হয়তো তার জীবনই বদলে দেবে।